It’s a science fiction story written in Bengali. If you wish to read it, please use Google Translate or similar tools.
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় জনমানুষও নেই। তার মাঝে দিয়ে হনহন করে একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে।
পরণে হালকা নীল রঙের জিন্স আর ম্যাচিং গেঞ্জি।
এমনিতে বৃষ্টিতে ভেজা শুভর কাছে প্রিয় কিছু না। এখন বাধ্য হয়ে ভিজতে হচ্ছে।
টিউশনিতে গেছিলোও দেরী করে। পড়ানো শেষ করে বেরোতে বেরোতে প্রায় সাতটা বেজে গেছে। এখন তাড়াতাড়ি হলে গিয়ে কালকের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি না নিলে ফেইল নিশ্চিত। তাই ছাত্রের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আকাশে মেঘ দেখলেও পাত্তা দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা ভুলই ছিল।
পেছন থেকে বিকট শব্দে হর্ন বেজে উঠলো। তাড়াহুড়া করে রাস্তার পাশে সরে যেতে না যেতেই বেশ জোরে একটা মাইক্রোবাস চলে গেলো। যদিও যাওয়ার আগে বিদায়ী উপহার হিসেবে তাকে কাদা আর পানিতে মাখিয়ে দিতে ভুললো না।
“আরেহ…ধুর!” আপনমনেই গজগজ করতে করতে ঠিক করলো, আর না। বৃষ্টি থামতে যতই দেরী হোক, সে আশেপাশে কোনো ছাউনীতে অপেক্ষা করবে। সামনে ডানদিকে একটা রেস্তোরাঁ। সেদিকেই হাঁটা শুরু করলো।
“কী খাবেন, মামা?” রেস্তোরাঁর বয় জিজ্ঞেস করলো। তার মতো আরো বেশ কয়েকজন বৃষ্টিতে আটকা পড়ে বসে আছে।
“শিঙাড়া হবে?”
“হবে। কলিজার না সবজির?”
“সবজির। চারটা দিন”
অর্ডার নিয়ে বয় চলে গেলো।
অনেকক্ষণ হাটতে হাটতে তেষ্টা পেয়ে গেছে। টেবিলে আগে থেকেই কয়েকটা গ্লাস আর পানির জগ রাখা ছিল। সে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে চুমুক দিয়ে চারদিকে তাকালো।
একেবারে বিশেষত্বহীন সাধারণ রেস্তোরাঁ। মাঝারি সাইজের একটা ঘরে পাঁচ-ছয়টা টেবিল , কোণায় পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা রান্নাঘর। একদিকে ময়লা দেয়ালের অনেকটা জুড়ে মেনু আর মূল্যতালিকা টানানো। ওপরে নামটাও লেখা, “আনন্দ রেস্তোরাঁ”
বয় তার সামনে প্লেট নামিয়ে রাখলো।
শুভ একটা শিঙাড়া তুলে কামড় বসাতেই কারেন্ট চলে গেলো। সাথে সাথে তার মনে হলো অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে। লোডশেডিং তো এদেশে অপরিচিত কিছু না, তাহলে এরকম মনে হচ্ছে কেন?
এক মুহূর্ত পরেই ব্যাপারটা ধরতে পারলো।
আশেপাশে এতক্ষণ কাস্টোমাররা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলো, রেস্তোরাঁর বয়রা ছোটাছুটি করছিলো। এখন চারপাশ অন্ধকার হওয়ার পাশাপাশি সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেছে। এমনকি রাস্তা থেকে বৃষ্টির শব্দও আসছে না।
অবাক হয়ে মনের অজান্তেই খাওয়া থামিয়ে দিয়েছিলো সে। মুখের খাবার গিলে ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করলো। কিন্তু ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন না হয়ে যেন তার বদলেই ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। কারেন্ট চলে এসেছে।
কিন্তু কোথায় সেই আনন্দ রেস্তোরাঁ?
একটা বিশাল ঘরের মাঝখানে বসে আছে সে। ঘরের সবকিছুই সাদা। এমনকী তার সামনের টেবিলটাও কোন যাদুমন্ত্রবলে সাদা রঙের ধাতব একটি টেবিলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। হতভম্ব শুভর হাত থেকে শিঙাড়াটা প্লেটে খসে পড়লো। উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালো সে। চারকোণা ঘরটায় টেবিল-চেয়ারটা বাদে আর কোনো আসবাবপত্র নেই। জানালাবিহীন চারটা দেয়ালই একইরকম দেখতে, এমনকী ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য দরজাও নেই। শুভ হেঁটে হেঁটে তার সামনের দেয়ালটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, যে জায়গায় একটু আগেও রেস্তোরাঁর দরজা ছিল।
আমি কী পাগল হয়ে গেছি? ভাবলো সে। এখানে এলাম কীভাবে?
ঘুরে ঘরের অন্য প্রান্তের দেয়ালটার দিকে তাকাতেই নিজের মানসিক স্থিরতা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকলো না।
যে দেয়ালটা একটু আগেও পুরোপুরি খালি ছিল সেখানে এখন একটা কাঁচের স্লাইডিং দরজা। অর্ধস্বচ্ছ কাঁচের কারণে ওপাশে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে। এরপরে গিয়ে দরজাটা খুললো।
বাইরে সেই রাস্তা, যেটা দিয়ে ও একটু আগে রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিলো। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে শুভ রাস্তায় বের হয়ে এলো। ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই আবার চমকে গেলো।
কোথায় কাঁচের ঘর? আগের রেস্তোরাঁটাই ফিরে এসেছে সে জায়গায়, শাটার বন্ধ করা। আশেপাশে জনমানুষের চিহ্ন নেই।
মানুষের অবাক হওয়ার একটা সীমা থাকে। সেই সীমা কেউ পার করে ফেললে আর কোনোকিছুই তাকে অবাক করতে পারে না। তাই শান্তভাবেই রেস্তোরাঁর বন্ধ শাটারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো সে।
একটা ফোন করতে হবে তাকে। তার রুমমেট শফিককে।
কী বলবে? “দোস্ত, আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আনন্দ রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আশেপাশে কেউ নেই। প্লিজ বাইক নিয়ে চলে আয়, আমার মাথা ঘুরছে।”?
না, এটা বলাই যাবে না। তার শরীর খারাপ বললেই হবে। শফিক ছেলে হিসেবে যত কাঠখোট্টাই হোক, সে অনুরোধ করলে যত দ্রুত সম্ভব চলে আসবে।
শুভ পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। লক বাটনে প্রেস করলেই আনলক হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্ক্রিন অন্ধকার থেকে গেলো। খানিকটা বিরক্ত হয়েই আরো কয়েকবার প্রেস করলো।
প্রায় তিরিশ-চল্লিশবার প্রেস করার পরও যখন ফোন চালু হলো না, ততক্ষণে বিরক্তিটা রাগ এবং অনেকখানি ভয়ে পরিণত হয়েছে। ফোনের আশা ত্যাগ করে হাঁটা শুরু করলো শুভ। উদ্দেশ্য হলে গিয়ে বরফ ঠান্ডা পানিতে গোসল করে একটা ঘুম দিবে। হাঁটতে হাঁটতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো ও। একটু পরে একটা মোড় ঘুরতেই হঠাৎ চটকা ভাঙলো। সে একটু আগে যে জায়গা থেকে শুরু করেছিলো সেখানেই এসে পড়েছে!
অবিশ্বাসের চোখে আনন্দ রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো শুভ। চোখ ভালমত ডলে আবার চারদিকে তাকালো। হ্যাঁ, সে সত্যি সত্যিই ঘুরে ঘুরে ঠিক আগের জায়গায় চলে এসেছে।
শিট, নিশ্চয়ই ভুল করে ঘুরে এদিকে চলে এসেছি!
শুভ আবারো হাঁটা শুরু করলো।
দ্বিতীয়বার।
তৃতীয়বার।
চতুর্থবার।
পঞ্চমবার।
ক্লান্ত চোখে রেস্তোরাঁর দিকে তাকিয়ে আছে শুভ। এই নিয়ে পাঁচ নাম্বারবার সে ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় চলে এসেছে। তার অতি পরিচিত শহর আজ নিষ্ঠুর এক গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে। নিষ্ঠুর এবং নিস্তব্ধ।
ওহ, খোদা! কী হয়েছে আমার? প্রায় শোনা যায়না এমন গলায় বিড়বিড় করলো সে। ধপ করে ফুটপাথে বসে পড়লো। অনেক্ষণ একনাগাড়ে হেঁটে দেহে আর এক বিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট নেই।
মিনিট দশেক পর ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো শুভ। এতক্ষণ বেশি উত্তেজিত থাকার কারণে তার একটা সাধারণ কথা খেয়ালই হয়নি। আবহাওয়া ভাল থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় একজন মানুষও নেই কেন?
জোর করে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে তুললো সে। ফুটপাথের উল্টোদিকে পাঁচতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। টলতে টলতে গেটে গিয়ে কলিংবেল টিপলো।
আচ্ছা, দারোয়ান আসলে তাকে কী বলবো আমি? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো শুভ।
রাস্তায় কোনো সমস্যা বা কারফিউ টাইপের কিছু আছে কিনা, কেউ বেরোচ্ছে না কেন, এগুলোই, আর কী?
কিন্তু আমি যে বারবার ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় আসছি, সেটা? খোলা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম, সেখান থেকে আজব একটা সাদা ঘরে চলে গেলাম, সেই ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি বন্ধ রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেগুলো?
তোমার মাথায় সমস্যা দেখা গেছে, তাই। দারোয়ানকে কিছু না বলে তার ফোন দিয়ে কাউকে ফোন করলেই হবে।
ব্যাপারটার ফয়সালা হয়ে যেতেই আবার গেটের দিকে তাকালো শুভ। এখনো কেউ আসছেনা কেন? বিরক্ত হয়ে কলিংবেলে আরেকবার চাপ দিয়ে গেটে ধাক্কা দিলো। অবাক ব্যাপার, গেটটা আস্তে করে খুলে গেলো। নিশ্চয়ই তালা লাগানো ছিল না। ঢুকে পড়বে নাকি?
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কারো দেখা না পেয়ে ভেতরে ঢোকারই সিদ্ধান্ত নিলো। কাউকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
“এই ভাই, কেউ আছেন?” গ্যারেজে ঢুকে গলা উঁচু করে ডাকলো সে। কেউ জবাব দিলো না। আরো কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে হাল ছেড়ে দিলো সে। আশেপাশে কেউ যদি থেকেও থাকে, তার সাড়া দেয়ার ইচ্ছে নেই। নিজেই ঘুরে ঘুরে দেখা শুরু করলো।
কেয়ারটেকারের ঘর, ড্রাইভারদের বিছানা, দারোয়ানের ঘর সব ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। সিঁড়ি দিয়ে ফার্স্ট ফ্লোরে উঠলো শুভ। প্রত্যেক তলায় দুপাশে দুটো করে ইউনিট। প্রথমে বামদিকের ফ্ল্যাটে জিজ্ঞেস করবে মনস্থ করে কলিং বেল টিপলো। কেউ সাড়া দিলো না। একটু অধৈর্য হয়েই পরপর বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজালো সে। একই অবস্থা।
হতচকিত হয়ে সে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এবার অন্য ফ্ল্যাটের সামনে গেলো। কেন জানি তার মন বলছে এই ফ্ল্যাটেও কেউ নেই। একইসাথে সেই মনই প্রচন্ডভাবে চাচ্ছে যেন অন্তত একজন মানুষ এসে দরজাটা খোলে। কলিং বেলের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে শুভ লক্ষ্য করলো তার হাত অল্প অল্প কাঁপছে। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেলে পরপর দুইবার চাপ দিলো।
বিশ মিনিট পর।
চারতলায় বিল্ডিং এর সর্বশেষ ফ্ল্যাটটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুভ। এটাসহ অন্য সবগুলো ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দিয়েছে, দরজায় ধাক্কা দিয়েছে, গলা ছেড়ে ডাকাডাকি করেছে। কাউকে পায়নি। এখন আর চিন্তা করার মতো মনের অবস্থাও তার নেই। নিরাসক্তভাবে নকশাকরা কাঠের দরজাটির দিকে তাকিয়ে আছে সে।
কী মনে করে হ্যান্ডেল ধরে চাপ দিলো। নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেলো, ঠিক নিচে বিল্ডিং এ ঢোকার গেটটার মতোই। ভেতরে ঢুকলো সে।
সাজানো গোছানো একটি ফ্ল্যাট। টিভি, টেবিল-চেয়ার, সোফা সবই আছে, শুধু নেই তাদের মালিক। ঢুকেই হাতের ডানদিকে একটা বেডরুম পেলো শুভ। অচেনা একজনের বেডরুম ব্যবহার করা কতটা ভদ্রতাসম্মত হবে তা না ভেবেই সোজা বিছানার ওপর শুয়ে পড়লো। ফ্ল্যাটের মালিক যেকোনো সময় এসে আমাকে পুলিশে দিবে? দিক না। তাও যদি একজন মানুষকে দেখতে পারি!
এতক্ষণ ধরে পুরো বিল্ডিং খোঁজার পরিশ্রম, তার সাথে হতাশা শুভর ক্লান্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। বিছানায় শুতেই তার চোখ জড়িয়ে এলো। গভীর ঘুম।
“…মানসিক গঠন মানুষ থেকে অনেক সিম্পল হওয়ার জন্য অনেক আগে থেকেই মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সাইকোলজিকাল ড্রাগ ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে আসছেন। শুধু ড্রাগ-ই নয়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টও করা হয়েছে ইঁদুরের ওপর। মনোবিজ্ঞানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এরকম আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম যে “দ্য এলোন মেইজ টেস্ট”, সেটিরও সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো কিছু ইঁদুর… “ প্রফেসর শওকত হোসেন একঘেয়ে কন্ঠে লেকচার দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমদিকের বেঞ্চগুলোর গুটিকয়েক ছাত্র ছাত্রী তার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। বাকিদের কেউ ঝিমোচ্ছে, কেউ নিচু গলায় পাশের বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত।
মনোবিজ্ঞানে শুভর বিন্দুমাত্র আগ্রহ যদি কখনো থেকেও থাকে, প্রফেসর শওকত হোসেনের রোবটিক লেকচারে তা অনেক আগেই চলে গেছে। ভাবলেশহীন চেহারায় সে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও তার মন অন্য জায়গায়।
আচ্ছা, মানবজাতি কী আসলেই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক? নাকি তারাও শুধুমাত্র আরেকটা গবেষণার তুচ্ছ কিছু সাবজেক্ট?
চিন্তাটা এতই অদ্ভুত যে শুভ আরেকটু হলে নিজের মনেই হেসে ফেলছিলো।
স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে এটা। আর কিছু না হোক, কিছুক্ষণ সময় কাটবে। সাত পাঁচ ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লো ও।
“স্যার!”
প্রফেসর থেমে গেলেন। “কোনো প্রশ্ন?”
“জ্বি..এই দ্য এলোন মেইজ টেস্টে মানুষ কেন ইঁদুরকে সাবজেক্ট বানিয়েছিলো? আরেকজন মানুষ বা বানরকে নয় কেন?”
“মানসিক গঠনের জটিলতার পার্থক্যের জন্য। একটি ইঁদুরের মানসিক গঠন মানুষের তুলনায় অনেক সহজসরল, কিন্তু একজন মানুষ এ পরিস্থিতিতে মেইজ থেকে বের হওয়ার চিন্তা না করে ভাবা শুরু করবে তাকে মেইজে কে ঢোকালো এবং কেন ঢোকালো। সেসব ভাবনার ওপর নির্ভর করে সে যা সিদ্ধান্ত নিবে তা এক্সপেরিমেন্টের ফলাফলকে -”
“এরকম কী হতে পারে আমরাও এরকম একটা এক্সপেরিমেন্টের সাবজেক্ট?” স্যারকে থামিয়ে দিয়ে মাঝপথে প্রশ্ন করলো সে।
“ওয়াট? কোন এক্সপেরিমেন্ট?”
“ধরুন, এই পুরো পৃথিবী একটা এক্সপেরিমেন্টাল এরিয়া। এখানে দ্য এলোন মেইজের ইঁদুরগুলোর জায়গায় আছি আমরা, আর বিজ্ঞানীদের জায়গায় আছে অনেক বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী… যাদের তুলনায় আমাদের মানসিক গঠনও ইঁদুরের মত সহজ -”
শুভ কথা শেষ করতে পারলো না, তার আগেই পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়লো। সবাই এতক্ষণ ওদের কথাই শুনছিলো।
“শুভ আহমেদ, এটা মনোবিজ্ঞান ক্লাস, সাহিত্য ক্লাস না। এরকম গাঁজাখুরি থিওরি তুমি কীভাবে বের করেছো জানি না, কিন্তু আমি ফ্যাক্টস পড়াই, সাইন্স ফিকশন না। এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করছি না। আর কোনো প্রশ্ন?” প্রফেসর রাগত গলায় বললেন।
“কিন্তু স্যার, আসলেই যদি এরকম হয় তাহলে কী হবে?” সে হাল ছাড়লো না।
প্রফেসরের মুখ দেখে মনে হলো তিনি এবার শুভকে চুপ করানোর জন্য হলেও কোনো একটা উত্তর দিবেন।
“কোনো একটা সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টে যদি কোনো সাবজেক্ট এক্সপেরিমেন্টের অসুবিধা করে তুমি তাকে কী করো?”
“উম্ম…সরিয়ে দেই যাতে অন্য সাবজেক্টগুলোর মাইন্ডসেটে প্রভাব না ফেলে?”
“একজ্যাক্টলি। আমরা যদি আসলেই এরকম কোনো এক্সপেরিমেন্টের অংশ হয়ে থাকি, আর তোমার মতো কেউ সেটা রিয়েলাইজ করে, তাহলে তাকেও এক্সপেরিমেন্টের স্বার্থে সরিয়ে দেয়া হবে। আর কিছু?” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তিনি।
“না স্যার। থ্যাঙ্কিউ।” শুভ সিটে বসে পড়লো। থিওরিটা অদ্ভুত, সন্দেহ নেই – তবে মজার।
হঠাৎ ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসলো শুভ। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে।
একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না? হাই তুলে, চোখ ডলে চারদিকে তাকালো। গভীর রাত। জানালার মধ্যে দিয়ে পাশের বিল্ডিং এর আলো এসে পড়ছে।
শব্দটা!
হঠাৎ খেয়াল হলো তার। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো।
“কেউ আছেন? Anyone there?” নিচের রাস্তায় কে যেন চিৎকার করছে একটু পর পর। শুভর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। কোনোরকমে জুতাটা পড়েই সিড়ি দিয়ে দৌড় দিলো।
নিচে নেমে হাঁপাচ্ছে শুভ।
কোথায় গেলো শব্দের মালিক? পাগলের মতো চারিদিক তাকিয়ে খুঁজলো সে।
“কেউ আছে-” ডাকটা একটু সামনে থেকে শুরু হতেই শুভ প্রাণপণে শব্দের উৎসের দিকে দৌড় দিলো। নিজেও মুখে দ্বিগুণ জোরে চীৎকার করে যাচ্ছে।
বেশিদূরে যায়নি লোকটা, মোড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
একটু কাছে আসতেই শুভ চেহারাটা চিনতে পারলো।
“তুই!” বিস্মিত স্বরে বলে উঠলো সে।
“শুভ! এইখানে কী করিস!”
তার রুমমেট শফিক।
গতকাল যে পোশাকে দেখেছিলো এখনো সেটাই পড়ে আছে, কালো জিন্সের সাথে সাদা শার্ট।
খুশীতে শুভ কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলো না।
“শফিক, তুই বিশ্বাস করবিনা, আমার হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাহলে এই জায়গাটাকে ভূতে পেয়েছে! সেই সকাল থেকে হাটছি এখানে কিন্তু… “ হড়বড় করে বলে গেলো সে।
“কোনো মানুষ দেখিসনি”, শফিক শেষ করে দিলো।
“তুই কী করে জানিস?” চমকে গেল শুভ।
“এবং… ঘুরে ঘুরে বারবার একই জায়গাতে আসছিলি।”
হাঁ করে শফিকের দিকে তাকিয়ে থাকলো ও। “তুই এগুলো জানিস কিভাবে?”
“বলছি রে…আগে তোর ঘটনাটা বল, তারপর আমারটা বলি।”
শুভ হোটেলে ঢোকা থেকে শুরু করে জনমানবশূন্য একটা বাসায় গিয়ে রাত কাটানো পর্যন্ত সবই খুলে বললো। পুরোটা সময় শফিক একবারো বাঁধা দেয়নি। এবার সে ফুটপাথে বসে পড়লো। শুভও পাশে বসলো।
“দোস্ত…আমি জানিনা আমাদের দুইজনকেই জ্বীনে পেয়েছে কিনা; কিন্তু আমারো পুরো সেইম ঘটনা ঘটেছে। এখানেই। একই রেস্তোরাঁয় লোডশেডিং, এরপর সাদা ঘর, আশেপাশে কোনো মানুষ না দেখা, ফাঁকা বাসায় রাত কাটানো। তোকে দেখিনি। কালকে অনেক্ষণ ধরে একই রাস্তায় হেটেছি, খোদার কসম একবারো কোনো মানুষকে দেখিনি, তুই দূরে থাক। এতগুলো আজব ঘটনা যদি একসাথে না ঘটতো, তুই যে এখানে ছিলি সেটা বিশ্বাসই করতাম না।”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো শুভ। কী বলছে এই ছেলে!
“কি-কিন্তু… কীভাবে? ভূতের আসর? আমাদের মাথা খারাপ? ড্রাগস?” উত্তর দিতে গিয়ে সামান্য তোতলানো শুরু করলো, “আমরা এক এলাকায় সারাদিন, সারারাত থাকলাম, এ-একবারো কাউকে দেখলাম না…একটাও মানুষ নেই…যেন-” কথা আটকে গেলো ওর।
“আচ্ছা দোস্ত, এরকম হতে পারে না এই এলাকায় কোনো একটা মিলিটারি ইভাক্যুয়েশন হয়েছে? সেজন্য সবাইকে বাইরে নিয়ে সিল করে দিয়েছে আর আমরা দুইজন কোনোভাবে আটকা পড়ে গেছি?”
“সেটা দিয়ে মানুষ নেই কেন ব্যাখ্যা করা যায়… কিন্তু বাকিগুলো?”
“জানি না।” হাল ছেড়ে দিয়ে স্বীকার করলো শফিক।
“রাস্তা দিয়ে চীৎকার করতে করতে হাটছিলি কেন?” অন্য প্রসঙ্গে গেল সে।
“ঘুম ভেঙে গেলো কেন জানি, আর ঘুম আসছিলো না।”, একটু থেমে যোগ করলো শুভর রুমমেট, ”ভাবলাম এই এপ্রোচে কাউকে খুঁজে পাই কিনা।”
চুপচাপ বসে থাকলো দুজন কিছুক্ষণ।
“দোস্ত?” নীরবতা ভাংলো শফিক।
“বল”
“ক্ষুধা পেয়েছে তো।”
চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুভ। তারও।
“আর ক্ষুধা… দোকান পাবো কোথায়? সবই তো বন্ধ।”
“চল একটু ঘুরে দেখি অন্তত। দরকার হলে শাটার ভাংবো।”
এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও শুভ হেসে ফেললো। এটা খারাপ বলেনি ও।
একটু সামনেই একটা ফাস্টফুডের দোকান পাওয়া গেলো। বন্ধ। একটা ইট দিয়ে শফিক তালাটা ভেঙ্গে ফেলে শাটারটা উঁচু করলো। পাশের দেয়ালে সুইচবোর্ড। কয়েকটা সুইচ অন করতেই আলো জ্বলে উঠলো।
এক কোণায় বড় একটা ফ্রিজ রাখা। ভেতরে কিছু ঠান্ডা স্যান্ডউইচ আর বার্গার।
মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করতে দিয়ে শফিক শুভর দিকে ফিরলো।
“একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস, কারেন্ট কানেকশন কিন্তু অফ না।”
জবাবে শুভ আনমনে মাথা নাড়লো। ব্যাপারটা সেও অনেক আগে লক্ষ্য করেছে।
“কীরে দোস্ত, এত চুপচাপ কেন?”
“এখানে হচ্ছেটা কী ব্রো? কী চলছে এই জায়গায়? কালোজাদু? কার্ফিউ? ভাইরাসের এটাক? হিপনোটিজম?” শফিককে না, অনেকটা নিজেকেই প্রশ্ন করলো শুভ।
“জানি না রে…খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে নেই আগে।”
পিপ পিপ করে ওভেনটা খাবার গরম শেষ হওয়ার সংকেত দিলো। একটা আলমারির ভেতর কিছু ডিজপোজেবল প্লেট পাওয়া গেলো। প্লেটে খাবার নিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়লো দুই বন্ধু।
“তুই কালকে কোথায় ছিলি?”
“উম্ম?” মুখে খাবার থাকায় শফিকের কথা জড়িয়ে গেলো।
“মানে, আমি টিউশনি পড়িয়ে ভার্সিটির দিকে আসছিলাম, বৃষ্টি শুরু হওয়ায় হোটেলটায় এসে ঢুকি। এরপরই তো- “
“আমি বিকালে গেছিলাম ছোটচাচীকে দেখতে, সেখান থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তোর মত হোটেল আনন্দতে ঢুকি।”
“তুই সত্যি আমাকে দেখিসনি?”
“শুধু তুই না, রাস্তায় কোনো মানুষকেই দেখিনি। খালি হোটেলটার ভেতরে বেশ ভিড় ছিল।”
“কিন্তু একজন আরেকজন একবারো দেখলাম না কেন?”
“যে বৃষ্টি ছিল, কয়েক ফিট সামনে কী আছে সেটাই দেখছিলাম না। তাই হয়তো তুই দূরে থাকায় খেয়াল করিনি।”
“হতে পারে…“ আস্তে আস্তে বললো শুভ।
খাওয়া শেষ। প্লেটগুলো ডাস্টবিনে ফেলে উঠে দাঁড়ালো তারা। এবার কী? শুভ ভাবলো।
শফিকের মনেও একই কথা ঘুরছিলো। নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়ালো।
“এখন কী করবো, দোস্ত?”
“নো আইডিয়া।” একটু চুপ করে থেকে সে বললো।
“চল, একটু ঘুরে ঘুরে দেখি… যদি কাউকে পাই”
“চল।”
ফাস্টফুডের দোকান থেকে বের হয়ে আবারো হাঁটা শুরু করলো দুজন।
শুভ বেশ দ্রুত হাটে। তার সাথে তাল মিলাতে শফিক হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলো।
“শফিক?” শুভ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো।
“হ্যাঁ।”
“রাস্তাটা কী আবারো ঘুরে আগেরজায়গায় চলে আসবে?”
“জানি না রে।”
“একটা কাজ করে দেখলে হয় না?”
“কী?” নিরাসক্ত গলায় জবাব দিলো শফিক।
“আমরা তো গতকাল একদিকে হেটে একই জায়গায় ফিরে আসছিলাম, এখন দুইজন দুইদিকে গিয়ে দেখবো একই জায়গায় ফিরে আসি কিনা?”
উৎসাহিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো শফিক। এটা তার মাথায় আসেনি।
“শাব্বাস দোস্ত! চল করি, কাজ হতেও পারে।” শুভর পিঠে আন্তরিক একটা চাপড় বসালো সে।
শুভর মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে। “এখান থেকেই শুরু করি।” বললো।
“ওকে।” শফিক আর কথা না বাড়িয়ে উলটোদিকে হাঁটা শুরু করলো। শুভ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
যদি দুইজনে আবারো একজন আরেকজনের কাছে অদৃশ্য হয়ে যাই? ভাবনাটা মনে আসার সাথে সাথে চাপা দিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করলো। এখন আতংকিত হয়ে গেলে লাভের লাভ কিছুই হবেনা, খামোখা।
এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে তাকাতে হাটছে সে। ঠিক কোনজায়গায় এসে আবার আগের জায়গায় ফিরে যায় সেটা বের করেই ছাড়বে।
যাওয়ার পথে হাতের বামে আনন্দ রেস্তোরাঁ পড়লো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুভ। “ব্যাটা তোর জন্যই আমি আর শফিক এখানে আটকে আছি!” তিক্ত গলায় বিড়বিড় করলো ও।
সামনে একটা ছায়ামূর্তি দেখে যাচ্ছে না? চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করলো।
একটা মানুষ!
বুঝতে পারার সাথে সাথে দৌড় দিলো শুভ, আশায় বুক দুরদুর করে কাঁপছে।
কাছাকাছি যেতেই আশা আবারো হতাশায় পরিণত হলো। মানুষটা শফিক।
শফিক শুভকে দূর থেকে দেখেই চিনেছে। তাই উত্তেজিত না হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো।
“দোস্ত।”
শুভ কোনো জবাব দিলো না। এখনো হাঁপাচ্ছে।
“দোস্ত, সেইম কেইস।” অস্ফুট গলায় বলে উঠলো শফিক।
তারা দুজনে আবারো যেখান থেকে শুরু করেছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
মাথায় রক্ত উঠে গেলো শুভর। আশেপাশে তাকালো সে। একটা ইট পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। ইট? তাই সই।
হাতে ইটটা তুলে নিলো সে। সর্বশক্তিতে একটা বাসার জানালার দিকে ছুড়ে মারলো। জানালাটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়লো।
“কী করিস! মাথা খারাপ হলো নাকি তোর?” ভয়ার্ত গলায় চীৎকার করে উঠলো শফিক।
পাত্তা দিলো না সে। আরেকটা পাথর তুলে একটা বাসার গেটের দিকে ছুড়ে মারলো। ঝনঝন শব্দে গেটটা কেঁপে উঠলো। আর কিছু করার আগেই শফিক তাকে ধরে ফেললো।
“মাথা ঠান্ডা কর! এভাবে ভাংচুর করে লাভ কী!”
“আই ডোন’ট কেয়ার! যেই ব্যাটা আমাদের উপর এই যাদু করেছে সেই ব্যাটা হয় আড়াল থেকে বের হবে নাহলে পুরো এলাকা ভেঙে দিবো।” ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে বললো শুভ। ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।
“এভাবে ভাংচুর করে কী করবো আমরা? শান্ত হ, মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখি কোনো সমাধান পাওয়া যায় কিনা।” নরম গলায় বললো শফিক।
কাজ হলো তাতে খানিকটা।
“কোন জায়গা থেকে আমাদের ইনভেস্টিগেশন শুরু করা যায়?” অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় শুভ বললো।
“এই ঘটনাটা শুরু হয়েছিলো কোথা থেকে?”
“আমরা দুইজনেই এই রাস্তা দিয়ে হেটে আসছিলাম…আই গেস এই রাস্তাতেই যত গণ্ডগোল?”
মাথা নাড়লো শফিক, “আমার তা মনে হয় না।”
“তাহলে?”
“আনন্দ রেস্তোরাঁয় লোডশেডিং হওয়ার পরই সবকিছু উলটাপালটা হয়ে যায়। ওখান থেকে শুরু করি।”
কথাটা খারাপ বলেনি ও।
“ঠিক আছে, চল।”
যেদিকে আনন্দ রেস্তোরাঁ ফেলে এসেছে সেদিকে হাঁটা শুরু করলো শুভ, শফিক তাকে অনুসরণ করলো।
শাটারে তালা বন্ধ। আগের দোকানের মত একইভাবে এটায়ও ঢুকলো তারা। ভেতরে অন্ধকার। শফিক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করতে গিয়ে থেমে গেলো।
“দোস্ত, একটা কথা বলতে খেয়াল ছিল না। আমার ফোন অন হচ্ছেনা কেন জানি। তোরটায় চার্জ আছে?”
“আমারটাও। কিন্তু আমারটায় ফুল চার্জ ছিল। তাও ডেড।” শুভ জবাব দিলো।
“ব্যাড লাক…কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝছি না! সুইচবোর্ডটা কোথায় খুঁজে বের করি আয়।” শফিক ভেতরে ঢুকে গেলো।
শুভ পিছুপিছু যেতে যেতে পকেট থেকে ফোন বের করলো। জানে ডেড, তারপরো আনমনে লক বাটনে একবার চাপ দিলো।
তাকে চমকে দিয়ে ফোনের স্ক্রিন আলোকিত হয়ে উঠলো। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।
“শুভ?”
তাকে না দেখে আবারো ফিরে এসেছে শফিক। তার হাতে ফোনটা দেখে চোখ কপালে উঠে গেলো তার।
“শফিক, ব্রো, কাজ করছে!” জীবনে আর কোনোদিন নিজের ওয়ালপেপার দেখে এত খুশী হয়নি শুভ।
“কিন্তু, ক্যামনে! দ্যাখ তো নেটওয়ার্ক পাস কিনা, পেলে কাউকে ফোন কর জলদি!” শফিক কথা শেষ করতে পারার আগেই শুভ স্ক্রিনের উপর আঙুল চালানো শুরু করে দিয়েছে।
“নো নেটওয়ার্ক, ধুর।” একটু দেখেই হতাশ গলায় জানালো সে। শফিকের চেহারা দেখে মায়া হলো তার।
“বাদ দে, চল হোটেলের ভেতরটা ঘুরে দেখি।” নিরাশ গলায় জবাব দিলো সে
“বাই দ্য ওয়ে, সুইচবোর্ড পেয়েছি। কিন্তু কোনো লাইট জ্বলে না।” শুভ ভেতরে ঢোকার পর তার দিকে ফিরে বললো শফিক, “ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা অন কর, দেখি কিছু পাই কিনা।”
শুভ ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা অন করতেই তার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো।
এত আলো কেন?
চোখের সামনে হাত দিয়ে আড়াল করলো সে, একটু চোখ সয়ে আসতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।
শুভ আবারো সেই সাদা ঘরটায় দাঁড়িয়ে আছে, খালি এবার শফিকও আছে তার সাথে!
হতবাক হয়ে চারপাশটা দেখলো, এরপর শফিকের দিকে তাকালো। শফিকের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
কী হচ্ছে এসব!
“কী হলো এটা?” বিড়বিড় করলো শুভ। তার সামনে বামদিকে সেই টেবিলটা। উপরে কোনো প্লেট নেই। টেবিলটা আস্তে করে ছুঁয়ে দেখলো। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছেনা।
“খোদার কসম, আনন্দ থেকে আমি এখানেই এসেছিলাম!” শফিক মৃদুস্বরে বলে উঠলো।
“আমিও।”
“কীভাবে?” নিজেকেই শোনালো যেন শফিক।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো দুই বন্ধু।
মনটা কেন জানি খচখচ করছে শুভর। কী যেন আগেও ঘটেছে, ঠিক একই ভাবে।
আনন্দ রেস্তোরাঁ থেকে এখানে চলে আসা?
উঁহু।
ফোন।
ফ্ল্যাশলাইট!
“শফিক, তুই আনন্দ থেকে এখানে আসার আগে কী করছিলি?”
“বসে ছিলাম।” শফিক জবাব দিলো।
“না মানে, বসে কী করছিলি?”
“কিছুই না, জাস্ট বসে ছিলাম। খাবারের অর্ডারও দেইনি, এইসময় হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলো – “
“আর তুই ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাতে গেলি।” শুভ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
“হ্যাঁ… তুই কীভাবে জানলি?”
“‘কজ আই ডিড দ্য সেইম থিং টু! আরো একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?” সে উত্তেজিত গলায় বললো।
“কী?” শুভ কী নিয়ে এত উত্তেজিত বুঝতে পারলো না শফিক।
“আমি একটু আগে লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করতেই টেলিপোর্টের মত এখানে চলে আসলাম, পুরো একই জিনিস!”, শুভ যোগ করলো, “এই ঘটনাটা কোনোভাবে আমাদের এই জায়গা পরিবর্তনটা ট্রিগার করছে।”
“কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ঘটনা কীভাবে এটা করে?” শফিকের গলায় সংশয়।
“জানি না, কিন্তু আমাদের হাতে আর কোনো হাইপোথিসিস নেই। এটা নিয়েই এগোতে হবে।”
শুভ দ্রুতপায়ে চেয়ারটার পাশে দাঁড়ালো। “ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানোর আগের ঘটনাটা ছিল চেয়ারে বসা। এখন সেটা করে দেখি কী হয়!”
“দাঁড়া দাঁড়া” শফিক বাঁধা দিয়ে বললো, “তোর এই থিওরি যদি সত্যি হয়ও, এরপর আমরা কোথায় চলে যাবো? আবার কোনো জনমানবহীন শহরে?”
“মনে হয়না। এর আগের জায়গা ছিল আনন্দ রেস্তোরাঁর সেই সময়টায়, যখন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। সেখানেই চলে যাবো আশা করি।” একটু দ্বিধা করে বললো শুভ।
“ঠিক আছে, কর তাহলে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও।
আশায়, উদ্বেগে দুজনেরই বুক ধুকপুক করছে। শফিকের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশেভাবে হাসলো শুভ। চেয়ারটায় বসে পড়লো।
বসার সাথে সাথে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো।
অনেক কষ্টে চোখ খুললো শুভ, কখন জ্ঞান হারিয়েছিলো নিজেই বুঝতে পারেনি।
চোখ খুলতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? অবাক হয়ে ভাবলো ও। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতে গেলো। অন্ধকার।
শফিক কই? বিদ্যুৎচমকের মতো চিন্তাটা এলো তার মাথায়। উঠে দাঁড়াতে গেলো।
“অযথা নড়াচড়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। তোমার শুধুমাত্র মস্তিষ্ক সজাগ, দেহ না।” একটা কন্ঠস্বর তার মাথার ভেতর ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো।
“ওয়াট দ্য!” সারাজীবনে এত চমকায়নি শুভ, “কে এটা?” আতংকিত হয়ে ভাবলো।
“তুমি মনে মনে কথা বললেই আমি বুঝতে পারবো।” কন্ঠস্বরটা আবার শোনা গেলো।
“কে আপনি?! আমার মাথার ভেতর কী করেন? আমাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে কেন?”
“আমরা কে তা বোঝার মত যথেষ্ট সংখ্যক নিউরোন তোমার মস্তিষ্কে নেই। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরঃ তোমার এই অবস্থার জন্য তুমি নিজেই দায়ী।” ভাবলেশহীন গলায় ভেসে আসলো কথাগুলো।
প্রতিবাদ করার আগেই দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারালো শুভ।
তৃতীয়বার জেগে উঠেই মাথায় একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো সে। ব্যথাটা একজায়গায় না থেকে পুরো মাথাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমার মাথায় কী অপারেশন করা হয়েছে?
“না, অপারেশন না।” সাথে সাথে জবাব এলো। মুহূর্তের জন্য কনফিউজড হয়ে গেলো সে। এরপর মনে পড়লো সব।
“আপনারা কারা?” আবারো প্রশ্ন করলো শুভ।
“এই প্রশ্নের জবাব আগেও দিয়েছি। তোমার বুঝার ক্ষমতার বাইরে।”
একটু রেগে গেলো ও এবার, “দেখুন ভাই, আপনি মানুষ, জ্বীন-ভুত, এলিয়েন যাই হোন না কেন, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। গত দুই দিন ধরে আমার সাথে কী হলো? আমার মাথায় ব্যথা করছে কেন? আর আমার বন্ধু শফিক কোথায়?”
“সব প্রশ্নের উত্তরই পরে দেয়া হবে। শফিক ভালো আছে, যেমন সবসময়ই ছিলো।” মাথার ভেতরের কন্ঠটা উত্তর দিলো।
এ কি হেঁয়ালি না করে কোনো জবাব দিতে পারেনা? মহাবিরক্ত হয়ে ভাবলো সে। আচ্ছা, এরকম কী হতে পারে আমি স্বপ্ন দেখছি? স্বপ্নে নিজের সাথে কথা বলছি?
“না।” উত্তর এলো।
আপনাকে বলিনি। তিক্ত কন্ঠে বললো শুভ।
এভাবে কতক্ষণ থাকতে হবে আর? একটু পরে প্রশ্ন করলো ও। কোনো প্রত্যুত্তর এলো না।
এবার আপনাকেই বলছি। বিরক্ত হয়ে বললো সে।
আরো ৬৮ মিনিট। জবাব দিলো কন্ঠস্বরটা।
“শিট!”
এক ঘন্টা আট মিনিট পর।
গত ঘন্টাখানেক শুভ চিন্তা করে কাটিয়েছে। কখনো তার মাথার ভেতরের কন্ঠটা জবাব দিয়েছে, কখনো দেয়নি। ঘুমানোর চেষ্টা করেছে, মাথা ব্যথার জন্য পারেনি। দেহকে জাগানোর করার চেষ্টা করেছে, কোনো লাভ হয়নি। এখন অধীরভাবে এক ঘন্টা আট মিনিট শেষ হবার অপেক্ষা করছে।
“হ্যালো, শুনছেন? কতক্ষণ হয়েছে?” প্রশ্ন করলো সে।
একটু দেরী করে কন্ঠটা জবাব দিলো। ‘তোমার সব প্রশ্নের জবাব এখন পেয়ে যাবে।”
“এখন কী আমি জেগে উঠতে পারবো?” জিজ্ঞেস করলেও কথা শেষ করার আগেই বুঝতে পারলো তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করলো একটুক্ষণ। এরপর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
“শুভ, তুমি কী আমাদের কথা শুনতে পারছো?” বহুদূর থেকে ভেসে আসছে একটা কন্ঠ…
শুভ সাড়া দেয়ার চেষ্টা করলো। মাথাটা এত ভারী লাগছে কেন…
“তোমার মস্তিষ্ক থেকে গত দুইদিনের স্মৃতি আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মুছে ফেলা হবে। এই পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা পুরো ঘটনাটা তোমার কাছে ব্যাখ্যা করবো। এর আগেও করা যেতো, কিন্তু সেক্ষেত্রে স্মৃতিগুলো সাময়িক মেমোরি থেকে স্থায়ী মেমোরিতে চলে যাবার সম্ভাবনা ছিল।”
ও কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো।
“তুমি সম্ভবত কথা বলার চেষ্টা করছো। তোমাকে যে ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে, সেটার প্রভাব এখনো কাটেনি। একটু পরে ঠিকমত কথা বলতে পারবে।
চার মিনিট তিরিশ সেকেন্ড বাকি।
প্রথমে শুরু করি আমাদের পরিচয় দিয়ে।
আগেও বলেছি আমাদের প্রকৃত পরিচয় বুঝার মতো শক্তিশালি মস্তিষ্ক মানুষের নেই। তাই তুমি বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে পারবেনা, তবে অনুধাবন করতে পারবে।
প্রচলিত অর্থে আমাদের এলিয়েন বলতে পারো, যেহেতু আমরা পৃথিবীতে থাকি না। কিন্তু আমাদের দেহ জৈবিক না, আলোকরশ্মি দ্বারা গঠিত। সেজন্য আমরা চাইলে আলোর গতিতে চলাচল করতে পারি, এমনকী আলোর চাইতে বেশি গতিতেও। এই গতির মাধ্যমেই আমরা টাইম ট্র্যাভেল করতে পারি।
আমাদের প্রযুক্তি তোমাদের চেয়ে বহুহুণে উন্নত। তোমাদের বিজ্ঞানে যা কল্পকাহিনী হিসাবে দেখা হয়, তা আমাদের কাছে সাধারণ বিষয়।
গোটা সৌরজগৎ আমাদের কাছে কী জানো? একটা গবেষণাকেন্দ্র। এখানে প্রত্যেকটা গ্রহতেই আমাদের কিছু না কিছু গবেষণা চলছে এবং পৃথিবী সেগুলোর মধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে এইমুহূর্তে আছে ৭ বিলিয়নের মতো মানুষ। এই ৭ বিলিয়ন মানুষের প্রত্যেককেই আমরা আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করি, সেটা মানসিকভাবেই হোক কিংবা অন্যকোনোভাবেই হোক। তাদেরকে বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়ে তাদের আচরণ অবজার্ভ করি, অবজার্ভেশন শেষ করে আবার স্মৃতি মুছে আগের জায়গায় পাঠিয়ে দেই। তোমাকে যেটা করবো।”
“কিন্তু আমি কেন?”, অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে শুভ বললো, “আমাদের উপর এই গবেষণা করছো কেন?”
“তোমাকে এরকম কিছুতে পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না আমাদের। কিন্তু তুমি নিজেই আমাদের বাধ্য করেছো। মনে আছে ইউনিভার্সিটিতে দ্য এলোন মেইজ টেস্টের উপর নেয়া ক্লাসটা? ক্লাসের কারো মাথায় যে আইডিয়া আসেনি, সেটা তুমি পাবলিকলি তোমার স্যারকে বলেছো। ব্যাপারটা নিছক কাকতালীয়ও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের গবেষণার ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি, ঠিক যেরকম তোমার স্যার বলেছিলেন।
সেদিনের ক্লাসের সবার স্মৃতি থেকে এ অংশটা মুছে দেয়া হয়েছে, শুধু তোমার মস্তিষ্কে রাখা হয়েছে। এরপর আমরা আনন্দ রেস্তোরাঁসহ আশেপাশের এলাকা খালি করে তোমাকে দুই দিন নিজের মত চলতে দিয়েছি। সেখানেও তুমি প্রথম রাতেই সেই ক্লাসটাকে স্বপ্ন দেখেছ।”
“তুমি এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি। মানবজাতির উপর এভাবে গবেষণা চালাচ্ছো কেন?”
“কারণ তোমরা আমাদের পূর্বপুরুষ।”
কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো শুভ। বলে কী!
“আমরা তোমাদের পূর্বপুরুষ কীভাবে? আর যদি হয়েও থাকি, তাহলেই আমাদের উপর এত গবেষণা করার কী আছে?”
“আমরা আগেও বলেছি, আমরা টাইম ট্র্যাভেল করতে পারি। বহু আগেই আমরা ভবিষ্যতে গিয়ে আমাদের তখনকার অবস্থা দেখতে গেছিলাম। কিন্তু পাইনি। সারা বিশ্বের কোথাও আমাদের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, আমরা ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবো।
যেহেতু ভবিষ্যতের যেকোনো ঘটনার শুরু হয় অতীতে, তাই আমরা আমাদের আদি অবস্থা, অর্থাৎ মানবজাতিকে বিশ্লেষণ করে দেখছি ঠিক কোন ঘটনাটা আমাদের এই ভবিষ্যৎ নির্ধারন করেছে।”
কথাগুলো হজম করতে একটু সময় লাগলো ওর। নতুন কোনো প্রশ্ন করার আগেই কন্ঠটা আবার কথা বলে উঠলো, “তোমার হাতে আর মাত্র ৫০ সেকেন্ড আছে।”
“আর শফিককে কী করেছেন? ওকে কেন এই এক্সপেরিমেন্টে যুক্ত করেছিলেন?!” উৎকণ্ঠিত গলায় বললো শুভ।
“সারা পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে আমাদের প্রতিনিধি আছে। শফিকও তেমনই একজন। তাকেও আমরা তোমার ওখানে পাঠিয়েছি, সে দুইদিন একই পরিস্থিতির শিকার হবার অভিনয় করে গেছে। তুমি বুঝতে পারোনি।”
ব্যাটা আমার সাথে গুটিবাজি করেছে! ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো ওর।
“শেষ কিছু কথা বলে নেই। তোমাকে এখানে পাঠিয়ে ডেটা নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তুমি কেন দ্য এলোন মেইজ টেস্ট কন্সেপ্টের সাথে আমাদের পৃথিবীর উপর করা গবেষণা রিলেট করতে পারলে সেটা বের করা। যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, এখন আমরা সেগুলোর ওপর গবেষণা করবো। কিন্তু তোমাকে আমরা সবসময়ই নজরদারীতে রাখবো।
সময় শেষ। স্মৃতি মুছে তোমাকে ঠিক আগের জায়গায়, আগের সময়ই রেখে আসা হবে।”
আর কিছু বলতে পারার আগেই ও তৃতীয়বারের মত জ্ঞান হারালো।
“শুরু হয়েছে?” এক্স-১১ এর কাছে টেলিপ্যাথিক মেসেজ আসলো। এতক্ষণ সে-ই শুভর সাথে কথা বলছিলো।
“হ্যাঁ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব স্মৃতি মুছে যাবে।” একইভাবে জবাব দিলো সে। মেসেজটা পাঠিয়েছে তার সহকর্মী জেড।
“আমাদের সুপারকম্পিউটার এক্সপেরিমেন্টের ডেটা প্রসেস করা শেষ করেছে।”
“ফলাফল?”
কোনো জবাব দিলো না জেড।
“কী হলো?” একটু অসহিষ্ণু হয়ে বললো সে।
“…সুপারকম্পিউটার যা রিপোর্ট দিয়েছে তা অফিশিয়াল রিপোর্টে রাখা যাবে কিনা জানি না।”
“কিন্তু সেই রিপোর্টটা কী?!”
“শুভর মনে এই চিন্তাটা আসা, এই স্বপ্ন দেখা – এগুলো কাকতালীয় না। একটি বিশেষ পক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা করেছে।”
“মানে! কারা? অন্য কোনো প্রাণী? কোনো রোবট? অন্য কোনো সুপারকম্পিউটার?” উত্তরটা শুনে চমকে গেলো এক্স-১১
“আমাদের সুপার কম্পিউটার বারবার খুঁজেও অন্য কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব পায়নি। ঘুরেফিরে শুধু একটা দিকেই নির্দেশ করছে।সেটা হলো প্রকৃতি।” উত্তর দিলো জেড।
“প্রকৃতি কীভাবে আমাদের এক্সপেরিমেন্টে বাঁধা দিবে?”
“আমরা শুরু থেকেই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করে আসছি। টাইম ট্র্যাভেল, ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের চেষ্টা এসবকিছুই প্রকৃতির নিয়মের পরিপন্থী। তুমিও খুব ভাল করেই জানো সেটা।”, একটু থেমে আবার যোগ করলো জেড, “ শুভকে দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর আরো মানুষ এভাবে ভাবা শুরু করবে। একসময় আমাদের এই গবেষণা, এমনকী আমাদের পরিচয়ও আর গোপন রাখা সম্ভব হবে না।”
“কিন্তু তাই বলে তো আমরা এটা বন্ধ করে আমাদের বিলুপ্তির জন্য অপেক্ষা করতে পারিনা!” একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলো এক্স-১১।
“আমি পুরো গবেষণা বন্ধ করার কথা বলছি না। আমাদের খালি অন্য একটা মেথডে গবেষণা করতে হবে, যেহেতু এটা কাজ করছে না।”
এক্স-১১ কিছু বললো না। ভাবছে।
“আর এই ছেলেটা, শুভ।”
“কী হয়েছে ওর?”
“আমার মনে হয় শুভ আমাদের গবেষণার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা এলিমেন্ট। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ওকে বেঁছে নেয়া হলো কেন?”
“তারমানে ওকে নিয়ে আমাদের আরো এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে…হয়তো ওর উপরই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।”
“কীভাবে?”
“বাটারফ্লাই ইফেক্ট। পৃথিবীর এক প্রান্তে একটা প্রজাপতি ডানা ঝাপ্টালে অন্য প্রান্তে তা টর্নেডো ঘটাতে পারে। এখানে হয়তো শুভই আমাদের প্রজাপতি।”
জেড চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। এরপর মেসেজ পাঠালো, “হতে পারে, আমাদের গবেষণা করে তা বের করতে হবে। আমরা যদি কিছু বের করতে নাও পারি, আমাদের পরের প্রজন্ম করবে।”
“সেটাই। বিজ্ঞান একাডেমিতে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি।” এক্স-১১ জবাব দিলো।
“ঠিক আছে।”
টেলিপ্যাথিক সংযোগ কেটে গেলো। সামনের মাইন্ডপ্যাডটার ওপর মনোসংযোগ করলো সে। মনিটরে তার চিন্তার প্রতিফলন ঘটছে, রিপোর্ট তৈরি হয়ে যাচ্ছে নিমেষেই…
শুভ চোখ খুলে দেখলো আনন্দ রেস্তোরাঁর ভেতরে একটা টেবিলে বসে আছে। সামনে শিঙাড়ার প্লেট।
একটা শিঙ্গাড়া তুলে কামড় বসালো ও। হঠাৎ পেছন থেকে পিঠে চাপড় বসালো কেউ। ফিরে তাকালো সে। তার রুমমেট শফিক, হাসছে।
“কীরে? কী করিস এখানে?”
“বৃষ্টিতে আটকা পড়ে বসে আছি… “ সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করলো শুভ। শফিককে দেখে ওর এরকম অস্বস্তি লাগছে কেন?
“আমিও, কথা নেই বার্তা নেই এমন বৃষ্টি নামলো হঠাৎ।” শফিক বললো।
আনমনে মাথা নাড়লো শুভ। অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে অন্য দিকে তাকালো সে।
এমুহূর্তে শফিকের দিকে তাকালে অবশ্য খেয়াল করতো সে তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!